বিনোদন

রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কুরুচি আর বিকৃতির হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, এগিয়ে আসেনি পশ্চিমবঙ্গ – বলছেন দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় লেখিকা তাসলিমা

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, নামটার সাথেই জড়িয়ে আছে বাঙালির ভালবাসা, প্রেম, বিচ্ছেদ, দুঃখ, গর্ব, অহংকার এমন আরও কত ভাব। তাকে নিয়ে বিতর্কের শেষ আজও হয়নি। কেউ এই বিষয়ে বিতর্ক পছন্দ করেন তো কেউ রবীন্দ্রপ্রেমী হয়ে বিতর্কের কথা কানেও তোলেন না। তবে এবার রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে বিতর্কে বিস্ফোরক দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখিকা তাসলিমা নাসরিন। লেখিকার মতে রবীন্দ্রপ্রেমে পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গ হাবে ভাবে, সাংস্কৃতিতে রাবীন্দ্রিক হলেও রয়েছে কবিগুরুর প্রতি ভালোবাসা ও নিষ্ঠার অভাব। আর সেই কারণেই এখন পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্র সংগীত বিকৃতভাবে গাওয়া চলে। যা বাংলাদেশের কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়।

লেখিকা তাসলিমা নাসরিন সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কথা। বিভিন্ন সামাজিক বিষয় সম্পর্কে লেখিকা নিজের বক্তব্য পেশ করে থাকেন সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট এবং নিজের লেখার মাধ্যমে। তেমনি একটি সামাজিক বিষয় নিয়ে লেখিকা একটি পোস্ট করেন যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কুরুচি আর বিকৃতির হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, এগিয়ে আসেনি পশ্চিমবঙ্গ। তাই বাংলাদেশের হিরো আলমকে পুলিশের কাছে গিয়ে মুচলেকা দিতে হয়েছে বিকৃত সুরে এবং ভুল উচ্চারণে রবীন্দ্রসঙ্গীত সে আর গাইবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রোদ্দুর রায়কে এ কারণে পুলিশেরা তলব করেনি, তাকে এ ধরনের কোনও মুচলেকাও দিতে হয়নি।’ লেখিকা তার লেখার শাণিত তীর ছুড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের দিকে। তিনি আরো বলেন, ‘যেমন ইচ্ছে তেমন করে গান গাওয়ার অধিকার পশ্চিমবঙ্গে বেশি, এমনকি রবীন্দ্রসঙ্গীতও রুচিহীন ভাবে গাওয়ার অধিকার মানুষের আছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিকৃত সুরে ভুল উচ্চারণে অন্য যে কোনও গান গাওয়ার যে কারও অধিকার থাকুক, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার অধিকার নেই। লোকে যে যা-ই বলুক, বাংলাদেশের এই রবীন্দ্রপ্রেম আমার বেশ ভাল লেগেছে। পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্রপ্রেমে সারা বছর হাবুডুবু খেলেও, প্রেমদৌড়ে বাংলাদেশের কাছে এ বার গোহারা হেরেছে বটে।’

তবে কি রবীন্দ্র সংগীতকে রাবীন্দ্রিক সুরে গাওয়া রবীন্দ্র প্রেমের পরিচয়ক?এই নিয়ে জনপ্রিয় এক সংবাদ মাধ্যম বিভিন্ন শিল্পীদের কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নেন। সেখানে সাহানা বাজপেয়ী বলেন, ‘‘ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলনের সময় রেডিয়োতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান সরকার। সনজিদা খাতুন বলেছিলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের অস্ত্র। দুই বাংলার একাত্মতার স্মারক। রবীন্দ্রনাথের গান সে সময়ে খুব বড় জায়গা ছিল বাংলাদেশের কাছে। সেখানকার মানুষ রবীন্দ্রনাথকে যে ভাবে আবিষ্কার করেছেন, সেটা খুব আলাদা। এর মধ্যে অনেকখানি রাজনৈতিক – সাংস্কৃতিক অধ্যায় রয়েছে। পশ্চিমবাংলার মানুষকে রবীন্দ্রনাথের জন্য কোনও যুদ্ধ করতে হয়নি। তবে আমি বলব, এ নিয়ে দুই বাংলার মধ্যে কে বেশি রবীন্দ্রপ্রেমী— এই বিতর্ক উত্থাপন বিষয়টাকে লঘু করে দেয়।’’

এই বিষয়ে লেখিকাকেই সমর্থন করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু সংগীতশিল্পী। তাদের মধ্যে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘তসলিমা ঠিকই বলছেন। কবিপক্ষে আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে ভালবাসা দেখাই, সেটা সারা বছর কোথায়? তাঁকে মহাগুরুর জায়গায় রাখি ঠিক কথা, কিন্তু সত্যিকারের বুঝতে যে চর্চা দরকার, সেটা আমরা করি না। আমাদের আসর জমানো গানের মাঝে হারিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ। সত্যিই অনেকটাই লোকদেখানো প্রীতি বলে আমার মনে হয়। তবে হ্যাঁ, স্বরলিপি মেনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ারই পক্ষে আমি। যতই নিরীক্ষামূলক গান ট্রেন্ড হোক, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের মন থেকে যে গান যে ভাবে ভেবেছেন, সেটা সে ভাবেই গাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’’ আবার সংগীত শিল্পী কে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় তবে কি আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোবে না রবীন্দ্র সংগীত? তখন তিনি বলেন, ‘‘তা কেন! রবীন্দ্রসঙ্গীতে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হোক। সেই সুযোগ তো রয়েছে এখন। তবে বিষাদের জায়গায় উল্লাসের আবহ বাজিয়ে দিলাম, এমনটা যেন না হয়! রবীন্দ্রনাথকে বোঝার জন্য মেধার অভাব যেন না হয় এটুকুই কাম্য।’’

আরো এক জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য জানান, ‘‘রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসেন, নিজের মতো করে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করেন— এমন মানুষ দুই দেশেই আছেন। এ নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। গণতান্ত্রিক পৃথিবীতে কে, কী ভাবে মতপ্রকাশ করবেন, কোনটাকে ভাল বলবেন আর কোনটা বাড়াবাড়ি, সেটাও তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। তবে মানুষের শোনার কান রয়েছে, বোঝার বোধ রয়েছে। আমি যদি রবীন্দ্রনাথকে সত্যিই ভালবাসি, যখন গাইব, চাইব সেই ভালবাসা, ধ্যান যেন গানে প্রকাশ পায়।’’

Related Articles

Back to top button